Others Law


হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইনে মামলার বিচার পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা হয় না


এ দেশের সব নাগরিক আইনে সমান অধিকার নিশ্চিত করার জন্য আমাদের সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে_'সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান। আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।' নানা বিশ্লেষণে দেখা যায়, নতুন আইন প্রণয়ন কিংবা প্রচলিত আইনের পরিবর্তন, পরিমার্জন কিংবা সংশোধন_যা করা হোক না কেন, তা অসহায় মানুষগুলোর প্রতিকূলে এবং সবলদের অনুকূলে। আইন হতে হবে যুগোপযোগী। কেবল অভিযুক্ত হলেই তাকে শাস্তি দিতে হবে_এ ধরনের আইন কাম্য হতে পারে না। বহুলভাবে ব্যবহৃত একটি আইনের নানা দিক বিবেচনা করলে লক্ষ করা যায়, এ আইনে আসামি হওয়া মানেই ভাগ্যে জোটে কারাদণ্ড, জরিমানা বা উভয় দণ্ড। আইনটি হলো 'হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইন ১৮৮১' (নেগোসিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্ট অ্যাক্ট, ১৯৮১)। ১৪১টি ধারার সমন্বয়ে একটি বিশেষ আইন হলেও কেবল ১৩৮, ১৪০ ও ১৪১ ধারার প্রয়োগই এ আইনে দেখা যায়। এ আইনের সপ্তদশ অধ্যায়ের ১৩৮ ও ১৩৯ ধারায় চেক ডিসঅনার-সংক্রান্ত অপরাধ। তার বিচারের জন্য হস্তান্তরযোগ্য দলিল (সংশোধন) আইন, ১৯৯৪ (The Negotiable Instrument (Amendment) Act, 1994 (১৯৯৪ সালের ১৯ নম্বর আইন) দ্বারা নতুন সপ্তদশ অধ্যায় (Chapter XVII) সংযোজন করা হয়, যার মাধ্যমে ১৩৯ ধারার বিধান বিলুপ্ত করা হয়।

ওই সংশোধনীতে ১৩৮(১) ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি যে ব্যাংকে তার অ্যাকাউন্ট রয়েছে সেই অ্যাকাউন্ট থেকে কোনো ব্যক্তিকে কোনো পরিমাণ টাকা প্রদানের জন্য কোনো চেক ইস্যু করেন এবং তার ওই হিসাবে রক্ষিত টাকার পরিমাণ চেকটি পরিশোধ করার ক্ষেত্রে অপর্যাপ্ত হওয়ার কারণে অথবা ওই হিসাব থেকে টাকা পরিশোধের জন্য ওই ব্যক্তি ও ব্যাংকের সঙ্গে উপনীত কোনো সমঝোতা অনুসারে ব্যাংক কর্তৃক প্রদেয় টাকার পরিমাণের চেয়ে চেকে বর্ণিত টাকার পরিমাণ বেশি হওয়ার কারণে ব্যাংক কর্তৃক ওই চেকটি অপরিশোধিত অবস্থায় ফেরত আসে, তবে ওই ব্যক্তি একটি অপরাধ করেছেন বলে গণ্য হবে এবং তার জন্য তিনি এই আইনের অন্য কোনো বিধান ক্ষুণ্ন ব্যতীত এক বছর মেয়াদ পর্যন্ত কারাদণ্ডে দণ্ডিত অথবা চেকে বর্ণিত অর্থের দ্বিগুণ পরিমাণ অর্থদণ্ডে অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

তবে শর্ত থাকে যে এই ধারার কোনো কিছুই কার্যকর হবে না_। ১৩৮(১)(ক) চেকটি ইস্যুর ছয় মাসের মধ্যে অথবা এর কার্যকারিতা বিদ্যমান থাকাকালীন সময়ের মধ্যে যেটি আগে হয়ে থাকে, সে সময়ে চেকটি ব্যাংকে উপস্থাপন করা হলে। ১৩৮(১)(খ) চেকটির প্রাপক অথবা যথানিয়মে ধারক যিনিই হোন না কেন, তিনি ব্যাংক কর্তৃক চেকটি অপরিশোধিত অবস্থায় ফেরত আসার বিষয়টি অবগত হওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে চেকদাতাকে চেকে বর্ণিত টাকা পরিশোধের জন্য লিখিত নোটিশ প্রেরণ করে থাকলে; এবং ১৩৮(১) (গ) ওই নোটিশপ্রাপ্তির ১৫ দিনের মধ্যে চেক প্রদানকারী চেকের প্রাপক বরাবর উলি্লখিত পরিমাণ টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হলে পরবর্তী এক মাসের মধ্যে নালিশ দায়ের করবেন।

সংশোধনের পরও : পরবর্তী সময়ে ২০০০ সালে আইনটি আবারও সংশোধন করা হয়। ওই সংশোধনে ১৩৮(১) ধারায় জরিমানার পরিমাণ তিনগুণ, ১৩৮(১)(খ) এবং ১৩৮(গ) ধারায় ১৫ দিনের পরিবর্তে ৩০ দিন করা হয় এবং ১৩৮(ক) ধারা সংযোজনপূর্বক সংবিধানের ২৭ নম্বর অনুচ্ছেদে বর্ণিত মৌলিক অধিকার হরণপূর্বক আপিল দায়েরের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়। নতুন ১৩৮(ক) ধারায় বলা হয়েছে, ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধিতে যা কিছু বর্ণিত থাক না কেন, চেকে বর্ণিত টাকার কমপক্ষে ৫০ শতাংশ দণ্ডপ্রদানকারী আদালতে জমা প্রদান না করলে উচ্চ আদালতে আপিল করা যাবে না। ১৩৮(ক) ধারার সংযোজন ও প্রয়োগ সম্পূর্ণ মানবতাবিবর্জিত ও মৌলিক অধিকার হরণও বটে। রাষ্ট্র এই ধারাটিকে এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে, যার বিধান মোতাবেক কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা কম্পানি কাউকে চেক প্রদান করলে তার জন্য শাস্তি অবধারিত। শুধু তা-ই নয়, চেকদাতাকে উচ্চতর আদালতে সচরাচর আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। যদিও উচ্চ আদালতে আপিল বিচারপ্রক্রিয়ার একটি অংশ। আপিল কোনো নতুন বিচার বা প্রার্থনা নয়।

আপিলের ক্ষেত্রে বৈষম্য : চেক প্রদানের চেয়েও জঘন্যতম অপরাধ যেমন রাষ্ট্রদ্রোহিতা, হত্যা, গুম, অপহরণ, ডাকাতি, নারী নির্যাতন ইত্যাদি আইনেও বিচারের ক্ষেত্রে পারিপার্শ্বিক অবস্থার বিচার-বিশ্লেষণ করে শাস্তি প্রদান করা হয়। দণ্ডপ্রাপ্ত উচ্চ আদালতে নির্বিবাধে আইনে বিধানকৃত সময়ের মধ্যে কোনো শর্ত ছাড়াই আপিল দায়ের করে ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করতে পারে। তা ছাড়াও অর্থঋণ আদালত আইন (সংশোধন) ২০১০ (২০১০ সালের ১৬ নম্বর আইন) মোতাবেক জারির বিরুদ্ধে আপত্তি দাখিল প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, দাবি পেশ করার ক্ষেত্রে দরখাস্তকারী ডিক্রিকৃত অর্থের অথবা ডিক্রিকৃত অর্থের আংশিক ইতিমধ্যে আদায় হয়ে থাকলে অনাদায়ী অংশের ১০ শতাংশের সমপরিমাণ জামানত বা বণ্ড দাখিল করবে। এ ছাড়া অনুরূপ জামানত বা বণ্ড দাখিল না করলে দাবি অগ্রাহ্য হবে। অথচ ১৩৮(ক) ধারায় বলা হয়েছে, চেকে বর্ণিত টাকার কমপক্ষে ৫০ শতাংশ দণ্ডপ্রদানকারী আদালতে জমা প্রদান না করলে উচ্চ আদালতে আপিল করা যাবে না। এই ধারার বিধান প্রণয়ন করে একদিকে যেমন আসামিকে উচ্চ আদালতে যেতে বাধা প্রদান করে দণ্ডপ্রাপ্ত আসামির মানবাধিকার চরমভাবে ক্ষুণ্ন করা হয়েছে, অন্যদিকে এই ধারার প্রয়োগের মাধ্যমে অসাধু চেকের প্রাপককে অনিয়ম এবং অত্যাচারে উৎসাহিত করা হয়েছে ও সিভিল আদালতে গমনে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। সর্বশেষ ২০০৬ সালের ৩ নম্বর আইন দ্বারা সপ্তদশ অধ্যায়ের ১৪১ নম্বর ধারা সংশোধন করে বলা হয়েছে, ওই ধারার বিচারকার্য একটি দায়রা আদালতে অনুষ্ঠিত হবে।

বাস্তবতা : ১৩৮(ক) ধারাটি নতুনভাবে প্রবর্তন ও সংশোধনের পর অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, কেবল ঢাকা জজ কোর্টে যতগুলো চেকের মামলা করা হয়েছে, বিশেষ করে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক দায়ের করা হয়েছে, তার ৯৫ শতাংশ বানোয়াট। বা অধিক মুনাফা ও দুর্নীতিগ্রস্ত মন নিয়ে ঋণগ্রহীতাকে হয়রানি করার জন্য করা হয়েছে। আইনের কঠোর বিধান ও একতরফা বিচারের ফলে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান একদিকে নগদে মানি রসিদের মাধ্যমে ঋণের টাকা ঋণগ্রহীতাদের কাছ থেকে সংগ্রহ করছে, অন্যদিকে তাদের কাছে রক্ষিত সিকিউরিটি চেকগুলো ডিসঅনার করে হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইনের ১৩৮ ধারার বিধান মোতাবেক মোকদ্দমা দায়ের করছে। ফলে নিরীহ ঋণগ্রহীতারা একদিকে তার সর্বস্ব হারাচ্ছে, অন্যদিকে অহেতুক কারাদণ্ড ও জরিমানা ভোগ করে যাচ্ছে।

মামলার চার্জ গঠনে যে কয়টি বিষয় দেখা হয় : আদালত ১৩৮ ধারায় চার্জ গঠন করে বিচারকার্য সম্পন্ন করে রায় প্রদান করেন। যে কয়টি বিচার্য বিষয় গঠন করেন তা হলো : ১. আসামি কর্তৃক চেকটি প্রদান করা হয়েছে কি না, ২. চেকটি তার মেয়াদকালে ব্যাংকে উপস্থাপন করেছেন কি না, ৩. চেকটি অপর্যাপ্ত তহবিলের কারণে অপরিশোধিত হয়ে ফেরত এসেছে কি না, ৪. অপর্যাপ্ত তহবিলের কারণে অপরিশোধিত হয়ে ফেরত আসার পর বাদি ১৩৮(বি) ধারার বিধান মোতাবেক যথাসময়ে নোটিশ দিয়েছেন কি না এবং ৫. নোটিশপ্রাপ্তির পর আসামি টাকা পরিশোধ করেছেন কি না। ওই ধারাটি বিচারে প্রয়োগের ক্ষেত্রে তা বিবেচ্য হওয়া বাঞ্ছনীয় যে হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইন টাকা পরিশোধের চুক্তি সংবলিত এবং এরূপ প্রতিটি চুক্তির অনুকূলে থাকে কোনো না কোনো প্রতিবিনিময়। ওই বিনিময়ের মাধ্যমে সৃষ্ট দায়টি আইনে বলবৎযোগ্য কি না তাও বিচার্য বিষয়ে অন্তর্ভুক্ত হওয়া একান্ত আবশ্যক। স্বভাবতই প্রশ্ন করা সমীচীন যে যদি ওই পাঁচটি বিচার্য বিষয় গঠন করে বিচার সম্পন্ন করা হয়, তাহলে হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইনের ১৩৮-১৪১ ধারা ব্যতীত অপরাপর ধারাগুলো বাতিল করা শ্রেয় নয় কি?

শেষ কথা : আমাদের মহামান্য উচ্চ আদালতের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত থেকে সুস্পষ্টভাবে ধারণা পাওয়া যায় যে পার্টিগুলোর মধ্যে চুক্তিনামা সম্পাদিত হলে এবং ব্যবসায়িক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকলে ঋণের টাকা পরিশোধ না করলে এতে ফৌজদারি অপরাধ বা দায় সৃষ্টি হয় না। ফলে এ অর্থে উদ্ভব আপত্তি একমাত্র দেওয়ানি আদালতে বিচারযোগ্য, কিন্তু আইনের কূটকৌশলের কারণে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থঋণ আদালত কিংবা দেওয়ানি আদালতে মানি মোকদ্দমার উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে। প্রকারান্তরে হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইনের সুবিধা গ্রহণ করে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো আংশিক বা পূর্ণ ঋণ আদায়ান্তেও হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইনের ১৩৮ ধারার বিধান মোতাবেক মিথ্যা বিবৃতি প্রদানসাপেক্ষে আদালতে মোকদ্দমা দায়ের করে অপর পক্ষকে হয়রানির শিকার করছে। অন্যদিকে আদালতও মোকদ্দমার কোনো রকম সত্যতা যাচাই-বাছাই ব্যতিরেকেই বিচারকার্য পরিচালনা করছেন। অথচ বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের জন্য অনুসরণীয় নীতিমালার ৯৬৭ নম্বর নিয়মের এপেড্রিক্স-২-এর ১ নম্বর দফায় বলা হয়েছে, 'সুষ্ঠু ও ন্যায়বিচারের স্বার্থে আইন এবং আদালতের সৃষ্টি হইয়াছে। আইন ও ন্যায়নীতির ভিত্তি বিচারকগণের প্রধান দায়িত্ব।' এই দায়িত্ব পালনে বিচারকরা প্রধানত আইনের বিধান অনুসরণ করে চলবেন। কিন্তু শুধু আইন অনুসরণ করাই যথেষ্ট নয়। বিচারকালে ন্যায়বিচারের স্বার্থে নিরপেক্ষ ও প্রভাবমুক্ত থেকে পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে নীতিমালার আলোকে বিচারকার্য সম্পন্ন করবেন।


প্রিয়েমশন বা অগ্রক্রয়ের বিধান.


প্রিয়েমশন (Pre-emption) অর্থ অগ্রক্রয়। অগ্রক্রয়াধিকারমূলক অধিকার হলো কোনো ক্রেতার কাছ থেকে আবার ক্রয়ের অধিকার। শরিকের কোনো বিক্রীত জমি বহিরাগত ক্রেতার কাছ থেকে অপর কোনো শরিক কর্তৃক আদালতের মাধ্যমে মূল্য ও নির্ধারিত ক্ষতিপূরণের টাকা জমা দিয়ে ক্রয় করাকে প্রিয়েমশন বলা হয়। বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন-১৮৮৫, রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন-১৯৫০-এর ৯৬ ধারা এবং ১৯৪৯ সালের অকৃষি প্রজাস্বত্ব আইনের ২৪ ধারায় এ সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। ১৮৮৫, ১৯৫০ এবং ১৯৪৯ সালের আইন তিনটির যথাক্রমে ২৬, ৯৬(১৭) ও ২৪(১০) ধারায় মুসলিম আইন দ্বারাও অগ্রক্রয়ের অধিকার শুধু নিশ্চিত করা হয়নি বরং অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। কাজেই বাংলাদেশে প্রিয়েমশন সুবিচার, ন্যায়পরায়ণতা ও সুবিবেচনার বিষয় নয়; বরং আইন দ্বারা সংরক্ষিত অধিকার।

উলি্লখিত ২৬, ৯৬ এবং ২৪ ধারার বিধানের সঙ্গে মুসলিম আইনের মৌলিক পার্থক্য হলো, মুসলিম আইন অনুসারে অগ্রক্রয় করতে হলে আনুষ্ঠানিক দাবি অর্থাৎ মুসলিম আইনের ২৩৬ ধারা মোতাবেক বিক্রয়ের সংবাদ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অগ্রক্রয়ের অধিকার প্রয়োগের ব্যাপারে অভিপ্রায় বা 'তলব-ই-মৌসিবত' ঘোষণা করতে হয়। তলব-ই-মৌসিবত এভাবে পেশ করা চলে, " আমি আমার শুফার হক দাবি করছি (হেদায়া, ৫৫১)। সাক্ষীর সামনে দাবি করাকে বলে 'তলব-ই-ইশাদ'। মূল্য ও ক্ষতিপূরণের টাকা মামলায় ডিক্রি হওয়ার আগে আদালতে জমা দিতে হয় না। পক্ষান্তরে রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনের ৯৬ এবং অকৃষি প্রজাস্বত্ব আইনের ২৪ ধারা অনুযায়ী আনুষ্ঠানিক দাবি উপস্থাপন করতে হয় না। তবে মামলা দায়ের করার সঙ্গে সঙ্গে (along with the petition for pre-emption) বিক্রীত দলিলে উলি্লখিত জমির মূল্যসহ ক্ষতিপূরণের টাকা জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক।

কখন অগ্রক্রয়ের অধিকার জন্মায় : যখন কেউ সহ-অংশীদার বা শরিক (Co-sharer) ছাড়া তৃতীয় কারো কাছে সমপূর্ণ বৈধ ও ত্রুটিমুক্তভাবে জমি বিক্রি সম্পন্ন করে বিক্রিসংক্রান্ত নোটিশ জারি (Sale notice) করে। তখন অন্য বা অন্যান্য অংশীদার ওই বিক্রির নোটিশ পাওয়ার বা বিক্রির খবর বা তথ্য জানার তারিখ থেকে অগ্রক্রয়ের অধিকার জন্মায়।
অগ্রক্রয়ের আবেদন আদালতে পেশ করার সময়সীমা : বিক্রিসংক্রান্ত নোটিশ জারি কিংবা দলিল পূর্ণাঙ্গভাবে রেজিস্ট্রি অথবা বিক্রয় বিষয় জানার দুই মাসের মধ্যে আদালতের দ্বারস্থ হতে হয়। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, The State Acquisiton & Tenancy Act, 1950 কার্যকর হয় ১৯৫১ সালের ১৬ মে এবং ওই তারিখ থেকে Bengal Tenancy Act বাতিল হয়। (The new S.A.T Act has repealed the famous Bengal Tenancy Act, l885) এর দীর্ঘদিন পর ২০০৬ সালের ২০ সেপ্টেম্বরে আলোচ্য ৯৬ ধারার উপধারা ১৮টির মধ্যে ১২টিতে সংশোধনী আনা হয়। সেই সংশোধনী অনুযায়ী প্রতিকার প্রার্থনা বা মামলা করার সময়সীমা চার মাস থেকে দুই মাস করা হয়। ৯৬(১)(বি) ধারা অনুযায়ী কোনো অবস্থায় তিন (তিন) বছরের পর মামলা করা যাবে না।

সময়সীমা ৪ মাস, অতঃপর কমিয়ে দুই মাস, আবার তিন বছরের মধ্যে প্রতিকার প্রার্থনার বিষয়টি কারো কারো কাছে ঘোলাটে বা পরস্পরবিরোধী মনে হতে পারে। ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বরে সংশোধনীর আগে দলিল নিবন্ধন হওয়ার বা জ্ঞাত হওয়ার চার মাসের মধ্যে মামলা করার সময়সীমা ছিল। এই জ্ঞাত হওয়ার বিষয়টি ব্যাপক ও বিস্তৃত। অর্থাৎ কেউ যদি ১২ বছর পর বিক্রির বিষয় জ্ঞাত হয়, তাহলে ওই জানা থেকে চার মাসের মধ্যে অর্থাৎ দলিলের বিষয় জানার বারো বছর+চার মাস (১২ বছর ৪ মাস) সময় পেতেন। ২০০৬ সালের সংশোধনী অনুযায়ী ওই ব্যাপক ও বিস্তৃত সময়সীমার একটি রেখা টানা হয়েছে। ফলে যিনি যখনই বিক্রি বিষয় জানুক, কোনো অবস্থায় তিন বছর পর অগ্রক্রয়ের অধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন না।

কে কে এ অধিকার প্রয়োগ করতে পারে : ১৯৫০ সালের রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন অনুযায়ী_

ক. বিক্রীত জমির ওয়ারিশ সূত্রে শরিক।
খ. বিক্রীত জমির খরিদ সূত্রে শরিক।
গ. স্থানান্তরিত জমিসংলগ্ন জমির স্বত্বাধিকারী প্রজা।

ওই আইনের ৯৬ ধারা মোতাবেক অগ্রক্রয়ের অধিকার আদায়ে মামলা করতে পারতেন। কিন্তু পার্শ্ববর্তী (Contiguous) প্রজাদের অগ্রক্রয়ের সুযোগ থাকায় হাজার হাজার মামলার উদ্ভব হয়। মামলার এ সংখ্যাধিক্য বিবেচনায় নিয়ে ২০০৬ সালের ৩৪ নম্বর আইন দ্বারা ওই ৯৬ ধারার ১২টি উপধারা সংশোধন করতে বিক্রীত জমিসংলগ্ন স্বত্বাধিকারীকে অগ্রক্রয়ের মামলা করতে পারবে না। এ বিধান করা হয়েছে। ফলে সর্বশেষ অর্থাৎ ২০০৬ সালের ২০ সেপ্টেম্বর থেকে শুধু ওপরে বর্ণিত (ক) ও (খ) দফার শরিকরা এ অধিকার প্রয়োগ করতে পারেন। ভূমিসংলগ্ন প্রজার অগ্রক্রয়ের অধিকার আর নেই।

মুসলিম আইনের ২৩১ ধারা অনুযায়ী নিম্নলিখিত তিন শ্রেণীর ব্যক্তি অগ্রক্রয়ের দাবি করতে পারে।

১. সমপত্তির সহ-অংশীদার [শাফি-ই-শরিক]

২. খালাস বা অনুবন্ধের অংশগ্রহণকারী ব্যক্তি, যেমন কোনো সড়ক ব্যবহারের অথবা পানি নিষ্কাশনের অধিকারসমপন্ন ব্যক্তি [শাফি-ই-খালিত]; এবং ৩. সংলগ্ন স্থাবর সমপত্তির মালিক [শাফি-ই-জার]; তবে, তাদের ভাড়াটিয়ারা নয়। অথবা কোনো সমপত্তির বে-আইনি দখলদার ব্যক্তিও নয়। [বেঈলি, ৪৮১]। কোনো ওয়াকিফ অথবা মোতোয়ালির অগ্রক্রয়ের অধিকার নেই, কারণ ওয়াকফ সমপত্তির মালিকানা তাহার কাছে বর্তায় না। তবে বিক্রেতার জমি ও শাফির জমির মধ্যে সরকারি জমি থাকলে সংলগ্নতা থাকবে না।

অগ্রক্রয়ের মামলা করার নিয়ম : অগ্রক্রয়ের অধিকার আদায়ের জন্য ওপরে বর্ণিত ব্যক্তিরা ১৯৫০ সালের রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনের ৯৬ ধারা মতে_

ক. হস্তান্তরের বিষয় জানার বা দলিল রেজিস্ট্রি হওয়ার দুই মাসের মধ্যে মামলা দায়ের,
খ. মামলার আবেদনের সঙ্গে বিক্রয় মূল্যের ২৫ শতাংশ ক্ষতিপূরণ জমা দিতে হবে,
গ. এ ছাড়া বিক্রয় মূল্যের ওপর বার্ষিক ৮ শতাংশ সরল সুদ জমা দিতে হবে।

১৯৪৯ সালের অকৃষি প্রজাস্বত্ব আইন অনুযায়ী_

১) অগ্রক্রয়ের দরখাস্তের সঙ্গে বিক্রীত মূল্যে ওপর ৫ শতাংশ ক্ষতিপূরণ জমা দিতে হয়, ২) অগ্রক্রয়ের দরখাস্ত জমা দেওয়ার সময়সীমা এক মাস, ৩) ক্রেতা, প্রতিপক্ষ খরিদের পর জমির উৎকর্ষ সাধনের কোনো অর্থ ব্যয় করলে তার ওপর শতকরা সোয়া ছয় টাকা হারে সুদ দেওয়ার বিধান আছে।

ওপরের শর্তগুলোর কোনো ব্যত্যয় ঘটলে প্রিয়েমশনের দরখাস্ত অগ্রাহ্য হবে। এত কিছুর পরও ১৯৫০ সালের রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনের ৯৬ এবং ১৯৪৯ সালের অকৃষি প্রজাস্বত্ব আইনের ২৪ ধারা বিধান অনুযায়ী নিম্নবর্ণিত ক্ষেত্রে অগ্রক্রয়ের মামলা চলে না, যদি_

১. বিক্রীত জমি বসতবাড়ি হয়।
২. অগ্রক্রয়ের মামলা দায়ের করার আগে বিক্রীত জমি বিক্রেতার কাছে হস্তান্তরিত হয়।
৩. উক্ত বিক্রয় যোগসাজশী (Collusive) বা জাল (Fraudulent) বিবেচিত হয়।
৪. বিনিময় বা ভাগবাটোয়ারাসংক্রান্ত সম্পত্তি হস্তান্তর হয়।
৫. স্বামী স্ত্রীকে বা স্ত্রী স্বামীর বরাবরে উইল বা দানমূলে সম্পত্তি হস্তান্তর করে।
৬. হেবা-বিল-এওয়াজ মূলে হস্তান্তর করলে।
৭. রক্তের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত তিন পুরুষের কোনো দান বা উইল মূলে হস্তান্তর করে।
৮. মুসলিম আইনে ওয়াক্ফ এবং ধর্মীয় কারণে বা দাতব্য উদ্দেশ্যে উৎসর্গকৃত হস্তান্তরে।

কোন আদালতে যাবেন : যে আদালতের 'Suit for recovery of possession' বা দখল পুনরুদ্ধারের মামলা গ্রহণের এখতিয়ার আছে শুধু সেই আদালত 'application for pre-emption' গ্রহণ করতে পারেন। অর্থাৎ যে জমি নিয়ে প্রিয়েমশন মামলা করা হয়েছে সেই জমি নিয়ে কোনো দখল উদ্ধারের মামলা দায়ের করলে যে আদালতে দায়ের করতে হয় প্রিয়েমশন মামলাটিকে সেই আদলতে দায়ের করতে হবে। আরো সোজা কথায় বলতে গেলে দলিলের মূল্যমান অনুযায়ী এখতিয়ারবান অর্থাৎ দুই লাখ টাকা পর্যন্ত সহকারী জজ, দুই লাখের ঊর্ধ্বে কিন্তু অনূর্ধ্ব চার লাখ পর্যন্ত সিনিয়র সহকারী জজ এবং তদূর্ধ্ব সব পরিমাণ মূল্যমানের জন্য যুগ্ম সহকারী জেলা জজ আদালতে এ মামলা করা যাবে।

আপিলের বিধান : রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৫০-এর ৯৬(১২) ধারা অনুযায়ী আদালতের আদেশের বিরুদ্ধে একবার আপিল করা যাবে। কিন্তু ওই আপিলের রায়ের বিরুদ্ধে আর দ্বিতীয় আপিল করা যাবে না। তবে প্রথম আপিলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ১৯০৮ সালের দেওয়ানি কার্যবিধির ১১৫ ধারা অনুযায়ী Revision দায়ের করা যায়।




মোবাইল কোর্ট আইন-২০০৯ কিছু কথা

 

'মোবাইল কোর্ট আইন' ২০০৯ সালের অক্টোবর রাষ্ট্রপতির অনুমোদন লাভ করে। আইনের ভূমিকায় আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্যের বর্ণনায় বলা হয় জনস্বার্থ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং অপরাধ প্রতিরোধ কার্যক্রমকে কার্যকর অধিকতর দক্ষতার সঙ্গে সম্পাদন করার জন্য নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে কিছু অপরাধ তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাস্থলে আমলে নিয়ে দণ্ডারোপের সীমিত ক্ষমতা অর্পণ করে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা সমীচীন প্রয়োজনীয় হওয়ায় অত্র আইন প্রণয়ন করা হলো।
আইনের () ধারায় বলা হয় যে অত্র আইনে তফসিলে বর্ণিত আইনের বিধান মোতাবেক কৃত অপরাধের বিচার করতে বিজ্ঞ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট অথবা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ক্ষমতাপ্রাপ্ত বটে। আইনের তফসিলে সর্বমোট ৬৫টি আইন উল্লেখিত আছে। আইনে সর্বমোট ১৭টি ধারা সনি্নবেশিত আছে।

মোবাইল কোর্ট পরিচালনার পদ্ধতি বর্ণিত আছে ধারায়। ধারায় বলা হয়, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট অভিযোগ আমলে নেওয়ার পর সংক্ষিপ্ত চার্জ গঠন করে তা অভিযুক্ত ব্যক্তিকে পড়ে শোনাবেন। অতঃপর অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করবেন তিনি অভিযোগ স্বীকার করেন কি না। অভিযুক্ত ব্যক্তি অভিযোগ স্বীকার না করে সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট অভিযুক্ত ব্যক্তিকে অব্যাহতি দেবেন [ () ধারা] কিন্তু অভিযুক্ত ব্যক্তি অভিযোগ স্বীকার করলে তাঁকে দণ্ড প্রদান করবেন [() ধারা] অভিযোগ স্বীকার করলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দুইজন সাক্ষীর স্বাক্ষর বা টিপসই এবং অভিযুক্ত ব্যক্তির স্বাক্ষর বা টিপসই নেবেন [() ধারা] বর্ণিত আইনটি আপাতদৃষ্টে একটি চমৎকার আইন মনে হলেও বাস্তবিক পক্ষে Constitutional Norms এবং Principles of Natural Justice-এর সব নীতিমালাকে উপেক্ষা করে মোবাইল কোর্ট আইনটি রচিত হয়েছে, যা সবিস্তারে আলোচনা করা হলো।

*
মোবাইল কোর্ট আইনের বিরুদ্ধে প্রথম আপত্তি হলো এটি Adversarial System of Criminal Justice সর্বৈব উপেক্ষা করো। আমাদের দেশের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় অভিযোগকারী এবং অভিযুক্ত মুখোমুখী বিজ্ঞ বিচারকের সামনে তাঁদের নিযুক্ত আইনজীবী দ্বারা মামলা প্রমাণ বা মিথ্যা প্রমানে আইনি লড়াই করে। উপস্থাপিত সাক্ষ্য প্রমানের আলোকে বিজ্ঞ বিচারক তাঁর সুচিন্তিত এবং সুসিদ্ধান্তিত রায় প্রদান করে। অথচ মোবাইল কোর্ট আইন সেই Adversarial System of Criminal Justice কে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করছে। এখানে উল্লেখ্য যে,অধুনা বিচার ব্যাবস্থায় পৃথিবীর অন্যান্য দেশে Inquisitorial Criminal Justice System প্রচলিত আছে। ব্যবস্থায় বিজ্ঞ বিচারক অভিযোগকারী এবং অভিযুক্ত ব্যক্তি উভয় পক্ষকে ব্যাপক প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে একটা বিচারিক সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। আলোচ্য মোবাইল কোর্ট আইনে প্রতিষ্ঠিত মোবাইল কোর্ট ঠিক Inquisitorial Criminal Justice System-এর মধ্যে পড়ে তা বলার কোনোই অবকাশ নেই।

*
মোবাইল কোর্ট আইনের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় আপত্তি হলো আইন বাংলাদেশ সংবিধানের বিধান দ্বারা প্রতিষ্ঠিত আইনি মৌলিক অধিকার Right to consult and be defended by a legal Practitioner of own choice মারাত্মকভাবে অস্বীকার করে। স্বীয় পছন্দের আইনজীবীর দ্বারা আনীত অভিযোগের সম্মুখে যথার্থ আইনি লড়াইয়ের অধিকার বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের সংবিধানের ৩৩() অনুচ্ছেদ দ্বারা স্বীকৃত। ফৌজদারি আইনি লড়াই করার জন্য নিযুক্ত বিজ্ঞ আইনজীবী দ্বারা তাঁর Defence Against Charge-এর যে সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার পেয়েছেন তা কোনো যুক্তিতে উপেক্ষা করা হলে সে বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যা বা ধারণা মোবাইল কোর্ট আইনের কোথাও নেই। কাজেই একথা নিশ্চিন্তে বলা যায়, মোবাইল কোর্ট আইনের বিচারে এক অভিযুক্ত ব্যক্তি তাঁর আইনগত বক্তব্য উপস্থাপনের ক্ষেত্রে Seriously without Represented.

*
মোবাইল কোর্ট আইনের বিরুদ্ধে তৃতীয় আপত্তি হলো এটি সংবিধান স্বীকৃত Right to Public Trial সমূলে অস্বীকার করে। সংবিধানের ৩৫() অনুচ্ছেদ মোতাবেক Right to Public Trial হলো Non-Derogable Right of every independent Citizen. এখানে একটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখ্য, Public Trial-এর মূল ভিত্তি হলো বিচার কাজটি হতে হবে জনসমক্ষে। কিন্তু তথাকথিত ঘটনা স্থলে। যেমন_ভেজালবিরোধী কার্যক্রমে বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট যদি রেস্টুরেন্টে অপরাধ সংঘটন হতে দেখেন তবে বিচার সেই রেস্টুরেন্টের ভেতরেই অনুষ্ঠিত হয়। বিচার দণ্ড প্রদানের প্রাক্কালে কোনো জনসাধরণকে উক্ত স্থানে RAB, Police এবং বিজ্ঞ Executive Magistrate কাউকেই ওই স্থানে থাকতে দেন না। মোবাইল কোর্টের এহেন আচরণ নিশ্চয়ই Public Trial Concept-এর মারাত্মক বৈপরিত্য বটে।

*
মোবাইল কোর্ট আইনের বিরুদ্ধে চতুর্থ আপত্তি হলো এটি মারাত্মকভাবে সর্বজনীন আইনের ন্যায়পর নীতিমালা Audi Atteram Partem Z_v No one shall be punished unheard নীতিমালাকে উপেক্ষা করে। Doctrine of Audi Alteram Partum মোতাবেক অভিযুক্ত ব্যক্তির অধিকার আছে তাঁর বিরুদ্ধে আনীত সাক্ষ্য (Evidence) অবলোকন করা এবং তা Ribut তথা খণ্ডন করা এবং উপস্থাপিত সাক্ষীদের (witnesses) প্রদত্ত Testimony তথা জবানবন্দি cross examine তথা জেরা করা। এখানে উল্লেখ্য, জেরা করা ফৌজদারি দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তির মৌলিক আইনগত অধিকার। কিন্তু মোবাইল কোর্ট আইনে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে দণ্ড প্রদানের ক্ষেত্রে এরূপ কোনো অধিকার প্রয়োগের সুযোগ দিয়ে কোনো বিধান রাখা হয়নি। মোবাইল কোর্ট আইন Fundamental Principle of Natural Justice-এর নীতিমালা তথা Audi Attarem Partem-এর Basic Foundation চিরতরে মাটি চাপা দিয়েছে। Audi Attarem Partem-এর Basic Foundation nGjv Lord Justice Jenkins-এর ভাষায়।

"A party to an action is Prima facie entitled to have it heard in his presence; he is entitled to dispute his opponent's case and cross examine his opponent's witnesses and he is entitled to call his own witnesses and give his own evidence before the Court [
rimshaw Vs. Dunbar (1953) 1 Q.B. 408 at 416]"

মোবাইল কোর্ট আইনের ১৭টি ধারা পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, ফৌজদারি বিচারব্যবস্থায় সার্বজনীন স্বীকৃত Audi Attarem Partem-এর সব শর্তগুলো উপেক্ষা করা হয়েছে, যেমন_

) কোন সাক্ষ্য উপস্থাপন এবং প্রদর্শনের (Exhibit) করার বিধান রাখা হয়নি।
) কোনো সাক্ষীর জবানবন্দি উপস্থাপনের বিধান রাখা হয়নি।
) অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আনীত অভিযোগের জবাবে জেরা করার বিধান রাখা হয়নি।
) অভিযুক্ত ব্যক্তি কর্তৃক নিজের সাফাইয়ের জন্য সাফাই সাক্ষী তথা (Defence witnesses) উপস্থাপনের সুযোগ দেওয়া হয়নি।

*
মোবাইল কোর্ট আইনের বিরুদ্ধে পঞ্চম আপত্তি হলো আইনের অধীন বিজ্ঞ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট একই সঙ্গে তদন্তকারী, আমল গ্রহণকারী এবং দণ্ড প্রদানকারী বিচারককে তিনটি ভিন্ন ক্ষমতা একই সঙ্গে প্রদান করা হয়। ফলে মোবাইল কোর্টের বিজ্ঞ বিচারক বাংলাদেশ সংবিধানে ৭৭ অনুচ্ছেদে বর্ণিত Ombudsman-এর চরিত্র পরিগ্রহ করেছে। The Executive Magistrate is wearing there crowns in one head like an Ombudsman এটা মোটেও কাম্য নয়। একই ব্যক্তি তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা একই সঙ্গে অর্জন করার ফলে একটা অযাচিত Dictator ship-এর জন্ম হওয়াই স্বাভাবিক।

*
মোবাইল কোর্ট আইনের ষষ্ঠ আপত্তি হলো এটা Judicial Magistrate এবং Executive Magistrate-এর মধ্যকার পার্থক্যরেখা ম্লান করে দিয়েছে। যেমন_মোবাইল কোর্ট আইনের () ধারা মোতাবেক বিজ্ঞ Executive Magistrate সর্বোচ্চ দুই বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড দিতে পারেন। ফৌজদারি কার্য সংহিতার ধারা ৩২() মোতাবেক বিজ্ঞ Judicial Magistrate of the 3rd Class সর্বোচ্চ দুই বছর কারাদণ্ড দিতে পারেন। কিন্তু অদ্ভুত বিধান এই যে Executive Magistrate আইনে স্বীকৃত যেকোনো অর্থ দণ্ড দিতে পারে অথচ বিজ্ঞ Judicial Magistrate of 3rd Class ২০০০ টাকার ওপরে অর্থ দণ্ড দিতে পারে না। Executive Magistrate Judicial Magistrate না হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে Judicial Magistrate-এর চেয়ে অধিক অর্থদণ্ডই প্রদানের ক্ষমতা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক এবং Separation of Judiciary-এর নীতিমালার সম্পূর্ণ লঙ্ঘন পরিপন্থী। এখানে উল্লেখ্য, Executive Magistrate-কে সংবিধান মোতাবেক একজন Ombudsman-এর মতো ক্ষমতা প্রদান করার কোনো যৌক্তিক কারণ বা ব্যাখ্যা আইনে নেই। অধিকন্তু Executive Magistrate বিচারিক হাকিম তথা Judicial Magistrate না হওয়া সত্ত্বেও কেন তাঁকে Judicial Magistrate-এর চেয়ে অধিক অর্থদণ্ড আরোপের ক্ষমতা প্রদান করা হলো তারও ব্যাখ্যা বা কারণ বর্ণিত হয়নি।

*
মোবাইল কোর্ট আইনের সপ্তম আপত্তি হলো আলোচ্য আইনটি Human Rights and their Norms-এর পরিপন্থী। মানবাধিকার আইনের মূলনীতি হলো Justice as per Rule of Law আর নেই Rule of Law কখনোই কার্যকর হয় না যখন ফৌজদারি বিচারব্যবস্থায় Rules of Fair Play অস্বীকার করা হয়। মোবাইল কোর্ট আইনে যেহেতু অভিযুক্ত ব্যক্তির আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য কোনো সময় মঞ্জুরের ব্যবস্থা নেই। এবং আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য বিজ্ঞ আইনজীবী নিয়োগের মাধ্যমে বক্তব্য উপস্থাপনের সুযোগ বিদান দুটোই নেই, সেহেতু মোবাইল কোর্ট আইন নিঃসন্দেহে মানবাধিকার আইনের নীতিমালার সঙ্গে মারাত্মক সাংঘর্ষিক। মানবাধিকার আইনের নীতিমালা মতে

একজন অভিযুক্তকে অবশ্যই নিম্ন লিখিত সুযোগ দিতে হবে।

) সুস্পষ্ট অভিযোগ লিখিতভাবে আনতে হবে।
) অভিযোগ সমর্থনে প্রমাণ উপস্থাপন করতে হবে।
) অভিযোগ প্রমাণে সাক্ষীদের জবানবন্দি নিতে হবে।
) অভিযুক্তকে অভিযোগকারী তাঁর সাক্ষীদের জেরার সুযোগ দিতে হবে।
) অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য প্রস্তুুতির পর্যাপ্ত সুযোগ সময় দিতে হবে।
) অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আত্মপক্ষ সমর্থনে নিজ পছন্দ মোতাবেক বিজ্ঞ আইনজীবী নিয়োগের এবং পরামর্শ গ্রহণের সুযোগ দিতে হবে।
) আত্মপক্ষ সমর্থনে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে সাক্ষ্য সাক্ষী উপস্থাপনের সুযোগ দিতে হবে। মোবাইল কোর্ট আইনের () ধারা মতে, লিখিত অভিযোগ গঠনের বিধান থাকলে অন্য সব বিষয়ে কোনো বিধান মোবাইল কোর্ট আইনে একেবারেই উল্লেখিত হয়নি। ফলে পুরো আলোচ্য আইনটি Fundamental Human Rights, যা সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদে স্বীকৃত আছে তা সমূলে উপেক্ষা করেছে। ফলে মানবাধিকার আইনের কষ্টি পাথরের বিচারে মোবাইল কোর্ট আইনটি আইন বলা অনভিপ্রেত বটে।
যাবৎ আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমার নিবেদন যে, স্বল্প সময়ের মধ্যে দ্রুত বিচার সম্পাদন অবশ্যই আশা জাগানিয়া বিষয় বটে। তবে দ্রুত বিচার হতে হবে আইনের নীতিমালা মানবাধিকার আইনের বিধিবিধান-সাপেক্ষে। যেকোনো আইন প্রণয়নে মনে রাখা দরকার যে, প্রণীত ফৌজদারি আইনটির কিছু গুণাবলি নিশ্চিত করে প্রণীত হয়েছে,

 যেমন :


. আইনটি হতে হবে Logical (যৌক্তিক)
. আইনটি হতে হবে Reasonable (সংগত)
. আইনটি হতে হবে Transparent (স্বচ্ছ)
. আইনটি হতে হবে Human Rights Oriented (মানবাধিকার সম্মত)
. আইনটি হতে হবে Constitutional guarantee (oriented) (সংবিধানের নিশ্চয়তা সম্মত)
. আইনটি হতে হবে Principles of Natural Justice oriented (ন্যায়পরায়ণ নীতিমালা সম্মত)
. আইনটি হতে হবে Procedurally fairness oriented (পদ্ধতিগত স্বচ্ছতাসম্মত)

কিন্তু আলোচ্য আইনটি পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার বিশ্লেষণে দেখা যায় যে ওই আইন ওপরে বর্ণিত সব নীতিমালা উপেক্ষা করে সরকারের একটি বিশেষ শ্রেণীর কর্মকর্তাদের খুশি করার জন্য ঝটপট আলোচ্য আইনটি প্রণয়ন করে। কিন্তু একটি কথা ভুলে গেলে চলবে না যে ইতিহাসের কোনো আইন মানবতাবিমুখ হয়ে দীর্ঘদিন টিকে থাকতে পারি।

যে আইন মানবাধিকার রক্ষা করতে পারে না, যে আইন ন্যায়পর নীতিমালা রক্ষা করতে পারে না, যে আইন সংবিধান সমুন্নত রাখতে পারে না, যে আইন সব স্বচ্ছতা, যৌক্তিকতা এবং পদ্ধতিগত সংহতি রক্ষা করতে পারে না, সেই আইন আর যাই হোক জনস্বার্থ রক্ষা আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে সক্ষম কথা বিশ্বাস করার কোনো যৌক্তিক অবকাশ নেই।

একথা সত্য, মোবাইল কোর্ট আইন সফল ভেজালবিরোধী অভিযান চালিয়ে মুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের প্রাণঘাতী কর্মতৎপরতা অনেকাংশে ঠেকিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও একথা ভুলে গেলে চলবে না যে, ভেজালবিরোধী কর্মে অনুসৃত আইনটিতে ভেজাল আইনের মূল উদ্দেশ্যকে ব্যর্থ পর্যুদস্ত করবে।





শ্রমজীবী নারীর মানবাধিকার আইনি সুরক্ষা


বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক উৎপাদন খাতগুলোর মধ্যে আশির দশকে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পাট, সুতা বস্ত্রশিল্পগুলো বন্ধ হওয়ায় একমাত্র পোশাকশিল্প খাত ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের সুযোগ সংকুচিত হয়ে গেছে। ফলে বেশির ভাগ শ্রমিকই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো_গার্মেন্টস, ইপিজেড, চিংড়ি খাত, বিড়ি কারখানা, চা-শিল্প, ধান প্রত্রিয়াকরণ শিল্প, ইটখোলা শ্রমিক, নির্মাণ শ্রমিক, ক্ষুদ্র ব্যবসায় নিয়োজিত শ্রমিক ইত্যাদি। এসব শিল্পের শ্রমশক্তি অর্ধেকই নারী। ছাড়া এই দুই খাতের বাইরেও রয়েছে কৃষিশ্রমিক গৃহশ্রমিক। সব ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক শ্রমের মানদণ্ড অনুযায়ী নারী শ্রমিকের অবস্থা সন্তোষজনক নয়। রাষ্ট্রীয় আইন অনুযায়ী নারী-পুরুষের মধ্যে কোনো মজুরির বৈষম্য নেই। কিন্তু কর্মরত নারী শ্রমিকরা ব্যাপকভাবে মজুরি বৈষম্যের শিকার হয়ে থাকে। মজুরি বৈষম্যসহ ছুটিহীন, অস্বাস্থ্যকর কর্মপরিবেশ এবং চলাচলে নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে এসব নারী শ্রমিকরা কাজ করে থাকে। সাধারণত নারী শ্রমিকরা ট্রেড ইউনিয়ন করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। ছাড়া তারা শিক্ষা, চিকিৎসাসহ অন্যান্য নাগরিক অধিকার সুযোগ-সুবিধাও পায় না। ফলে তারা সামাজিক অর্থনৈতিকভাবে ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছে। এসব অমানবিক জীবনযাপনের মধ্য দিয়েও বিভিন্ন শিল্পের নারী শ্রমিকরা তাদের শ্রমের বিনিময়ে দেশের অর্থনীতির ভিত শক্ত করার ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা রেখে আসছে।

পোশাক শিল্পের নারী শ্রমিক

বাংলাদেশে পোশাক রপ্তানি খাতে অধিংকাশই মহিলা শিশু এবং সবাই দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। শিল্প প্রসারের ফলে শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ আশাতীতভাবে বৃদ্ধি পায়। শিল্পে বর্তমানে কাজ করে প্রায় ৯০ শতাংশ নারী শ্রমিক। কিন্তু খাতে শ্রমিকদের সর্বাধিক অবদান থাকলেও তারা তাদের নূ্যনতম আইনগত অধিকারসহ মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যেমন_ন্যায্য মজুরি, সময়মতো মজুরি পাওয়া, কাজের সময়কাল, ছুটি, ক্ষতিপূরণ, স্বাস্থ্য সুরক্ষাসহ সব আইনগত অধিকার। তারা যেখানে কাজ করে সেখানে তাদের যে সব অধিকার আইনে স্বীকৃত এবং সেগুলো লঙ্ঘিত হলে কী পদক্ষেপ নেওয়া যায় সে সম্পর্কে তারা সচেতন নয়। তাই বিভিন্ন ধরনের কারখানায় দিনের পর দিন তাদের দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করানো হচ্ছে। নারী শ্রমিকদের ৮০ শতাংশ গার্মেন্টস কারখানায় যে সমস্যাগুলো বিরাজমান তা হলো_আইন অনুযায়ী সঠিক সময়ে নারী শ্রমিকদের মজুরি পরিশোধ না করা মজুরি বৈষম্য করা, শ্রমিকদের মজুরির সঙ্গে বাসস্থান, পরিবহন অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা না থাকা, আইন অনুযায়ী বেতনসহ সাপ্তাহিক ছুটি প্রদান না করা, বকেয়া বেতন ওভারটাইমের টাকা যথাসময়ে পরিশোধ না করা, শ্রমিকদের বাধ্যতামূলকভাবে ওভারটাইম করানো, কর্মক্ষেত্রে পর পর তিন দিন -১০ মিনিট দেরি হলে এক দিনের মজুরি কাটা, শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধ না করে ছাঁটাই করা, সাপ্তাহিক ছুটিসহ অন্যান্য ছুটির সুযোগ না থাকা, শ্রমিক ইউনিয়ন করতে না দেওয়া, মাতৃত্বকালীন ছুটির ব্যবস্থা থাকলেও বাস্তবে অধিকাংশ গার্মেন্টসে প্রয়োগ না করা, আইনে থাকলেও পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য কোনো শিশুপরিচর্যা কেন্দ্রের ব্যবস্থা না থাকা, আগুন লাগাসহ অন্যান্য দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য বিকল্প ব্যবস্থার পর্যাপ্ত অভাব, শ্রমিকদের স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা না থাকা, কাজের সময়কাল, ছুটি, ক্ষতিপূরণ, স্বাস্থ্য সুরক্ষাসহ সব আইনগত ব্যবস্থা না থাকা ইত্যাদি। এভাবে সর্বনিম্ন্ন মজুরিতে নারী শ্রমিকদের কাজের বিনিময়ে দেশের পোশাকশিল্পের মালিকরা যেমন লাভবান হচ্ছে তেমনি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নসহ খাত থেকেই আয় হচ্ছে সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রা।

কৃষিকাজে নিয়োজিত নারী শ্রমিক

ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্য ভূমিহীন হওয়ার কারণে নারীরা সামান্য মজুরির বিনিময়ে কৃষিতে কাজ করতে বাধ্য হয়। প্রযুক্তির ব্যবহার সাধারণত পুরুষের হাতেই থাকে। যদিও আইনে কৃষিকাজে নিয়োজিত নারী শ্রমিকদের কৃষিশ্রমিকের সংজ্ঞা থেকে বহির্ভূত করেনি, তবে স্বনিয়োজিত নারী শ্রমিকদের সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত করেনি। সাধারণত কৃষিকাজে নিয়োজিত এসব নারী শ্রমিককে শুধু সহায়তাকারী হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। কৃষিকাজে নিয়োজিত নারী শ্রমিকদের সাধারণত জমির ওপর কোনো মালিকানা নেই, তাদের ঋণ পাওয়া, উন্নত প্রযুক্তি সেবা পাওয়ার সুযোগ নেই। দেশের বিভিন্ন রাইস মিলে অসংখ্য শ্রমিক কাজ করে, এর মধ্যে অনেক নারী শ্রমিক রয়েছে। বর্তমানে আর্থ-সামাজিক অবস্থার কারণে মিলগুলোয় নারী শ্রমিকের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কৃষিকাজে নিয়োজিত নারী শ্রমিকদের বিরাজমান সমস্যাগুলো হচ্ছে_রাইসমিলগুলোয় কাজের সুনির্দিষ্ট কোনো সময়সীমা নেই, নারী শ্রমিকদের দৈনিক গড়ে ১৫ থেকে ১৬ ঘণ্টা কাজ করতে হয়, কাজের পরিবেশ পরিষ্কার-পরিছন্ন থাকে না, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করার ফলে শ্রমিকরা প্রায় অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং রাইসমিলগুলোয় কর্মরত শ্রমিকরা প্রতিনিয়ত ন্যায্যমজুরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, মজুরি বৈষম্যের কারণে নারী শ্রমিকদের মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় নারী শ্রমিকরা পুরুষ শ্রমিকদের চেয়ে অধিক কষ্টদায়ক ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে থাকে, বয়লার বিস্ফোরণ ঘটে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে থাকে ইত্যাদি।
অথচ ১৯৪৮ সালের মানবাধিকার সনদের ২৪ ধারায় উল্লেখ রয়েছে, 'প্রত্যেকেরই বিশ্রাম অবসর বিনোদনের অধিকার রয়েছে। কাজের সময় যুক্তিসঙ্গত সীমা বেতনসহ নৈমিত্তিক ছুটি অধিকারের অন্তর্ভুক্ত এবং জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্রে আছে, বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধাসহ সমান পারিশ্রমিক একই মানের কাজের ক্ষেত্রে একই আচরণ, সেই সঙ্গে কাজের মান মূল্যায়নের ক্ষেত্রে সবাই সমান আচরণের অধিকারী।'

নারী গৃহশ্রমিক

বাংলাদেশে অসংখ্য মানুষ গৃহকর্মী হিসেবে দেশে-বিদেশে বাসাবাড়ির কাজে নিয়োজিত রয়েছে, যাদের বেশির ভাগই হছে নারী শিশু। তবে নিবন্ধন না থাকায় তাদের সঠিক সংখ্যা নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। গৃহকর্মের সঙ্গে যুক্তদের সংখ্যা প্রতিদিন বৃদ্ধি পেলেও তাদের মজুরি নির্ধারণ অন্যান্য অধিকার সুরক্ষায় কার্যকর উদ্যোগ এবং আইনি কোনো ব্যবস্থা বিদ্যমান নেই। ফলে বিপুলসংখ্যক শ্রম জনগোষ্ঠীর শ্রমিক হিসেবে কোনো স্বীকৃতি নেই। শ্রমজীবী মানুষের আইনি সুরক্ষা প্রদানের জন্য বাংলাদেশ শ্রমআইন, ২০০৬ বলবৎ রয়েছে। কিন্তু আইনে গৃহশ্রম এবং গৃহকর্মীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এসব শ্রমিক সব ধরনের শ্রমঅধিকার থেকে বঞ্চিত। ফলে প্রতি বছর গৃহশ্রমিক নিপীড়ন নির্যাতনের কারণে তারা কর্মক্ষেত্রে মারা যাচ্ছে। ধরনের ঘটনার কোনো আইনগত প্রতিকারও হয় না। আশার কথা, সরকার গৃহশ্রমে নিযুক্ত বিপুল জনগোষ্ঠীর অধিকার সুরক্ষার জন্য গৃহকর্মী সুরক্ষা কল্যাণ নীতিমালা, ২০১০ প্রণয়ন করেছে। নীতিমালা গৃহকর্মে নিয়োজিত কর্মীদের নিবন্ধন, কাজের শর্ত নিরাপত্তা, শোভন কর্মপরিবেশ, মজুরি কল্যাণ নিশ্চিত করা, নিয়োগকারী গৃহকর্মীদের মধ্যে সুসম্পর্ক রাখা এবং কোনো অসন্তোষ সৃষ্টি হলে তা নিরসনে দিকনির্দেশনা প্রদান করেছে। যত দ্রুত সম্ভব নীতিমালার বাস্তবায়ন প্রয়োজন।

নারী শ্রমিকদের জন্য আইন ব্যবস্থাপনা

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধানের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে অনুচ্ছেদ ১৪, ১৫, এবং ২০()- শ্রমিকদের অধিকার বিষয়ে বলা হয়েছে। সংবিধানের ১৪ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'মেহনতি মানুষকে-কৃষক শ্রমিককে জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ হতে মুক্তি গ্রহণ রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হবে।' কিন্তু কর্মক্ষেত্রে এর তেমন প্রয়োগ এবং বাস্তবায়ন আমরা দেখতে পাই না। উপরন্তু নারী শ্রমিকের প্রতি নির্যাতন ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদে জনগণের মৌলিক অধিকার পূরণের নিশ্চয়তাসহ কর্মের গুণ মান বিবেচনা করে মজুরির বিনিময়ে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা এবং সামাজিক নিরাপত্তার কথা বলা হলেও প্রায় সব ক্ষেত্রে নারী শ্রমিক মৌলিক অধিকারবঞ্চিত মজুরি বৈষম্যের শিকার এবং নিরাপত্তাহীন জীবনযাপন করে থাকে।

সংবিধানের ১৪ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কর্ম হচ্ছে কর্মক্ষম প্রত্যেক নাগরিকের পক্ষে অধিকার, কর্তব্য সম্মানের বিষয় এবং 'প্রত্যেকের নিকট হইতে যোগ্যতানুসারে প্রত্যেককে কর্মানুযায়ী'_ নীতির ভিত্তিতে প্রত্যেকে স্বীয় কর্মের জন্য পারিশ্রমিক লাভ করিবেন।

ছাড়া সংবিধানের তৃতীয় অধ্যায়ে মৌলিক অধিকারে শ্রমিকদের অধিকার বিষয়ে বিশেষ অনুচ্ছেদ হচ্ছে ৩৪ ৩৮। ৩৪ অনুচ্ছেদটি শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষাকবচ। অনুচ্ছেদ মোতাবেক সব প্রকার জবরদস্তি শ্রমনিষিদ্ধ। ৩৮ অনুচ্ছেদে জনশৃংঙ্খলা নৈতিকতার স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে সমিতি বা সংঘ গঠন করার অধিকার দেওয়া হয়েছে।

২০০৬ সালে ২৭টি পৃথক আইনকে সমন্বয় করে একটি পূর্ণাঙ্গ 'বাংলাদেশ শ্রমআইন ২০০৬' প্রণয়ন করা হয়। ছাড়া অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের জন্য শ্রমিক কল্যাণ ফাউণ্ডেশন আইন, ২০০৬ এবং গৃহশ্রমিকদের সুরক্ষার জন্য গৃহকর্মী সুরক্ষা কল্যাণ নীতিমালা, ২০১০ প্রণয়ন করা হয়েছে। চা-শ্রমিকদের জন্য বাংলাদেশ শ্রমআইন, ২০০৬-এর পাশাপাশি বাংলাদেশ চা-শ্রমিক কল্যাণ তহবিল অর্ডিন্যান্স, ১৯৮৬ প্রচলিত আছে।

আন্তর্জাতিক শ্রমমান, অন্যান্য সনদ নারী শ্রমিক

* ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক প্রণীত সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার মধ্য দিয়ে 'আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিল' প্রস্তুতির উম্মেষ ঘটে।

* ১৯৬৬ সালে আরো তিনটি আন্তর্জাতিক দলিল প্রণীত হয়। সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণায় অন্যান্য মানবাধিকারের সঙ্গে নিজের দেশে সরকারি চাকরিতে সমান প্রবেশাধিকারসহ কাজের অধিকার, সমপরিমাণ কাজের জন্য সমপরিমাণ মজরির অধিকার, বিশ্রাম অবসর_এসব অধিকারকে গুরুত্বপূর্ণ মানবাধিকার হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।

* ১৯৬৬ সালে গৃহীত নাগরিক রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কিত চুক্তির মধ্যেও জবরদস্তিমূলক শ্রম থেকে মুক্তি এবং সরকারি চাকরিতে সমতার ভিত্তিতে প্রবেশাধিকারের ক্ষেত্রে অধিকার ভোগ করার বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

* ১৯৬৬ সালে গৃহীত অর্থনৈতিক, সামাজিক সাংস্কৃতিক অধিকার সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক চুক্তির মধ্যে কাজ করার অধিকার, কাজের জন্য সঠিক সুবিধাজনক অবস্থা ভোগের অধিকার, ট্রেড ইউনিয়ন গঠন তাতে যোগদানের অধিকার, সামাজিক নিরাপত্তা, সামাজিক বীমা প্রভৃতি ভোগ সংরক্ষণের অধিকার, যথাযথ জীবনযাত্রার মান রক্ষার অধিকার, সর্বোচ্চ অর্জন দ্বারা শারীরিক মানসিক স্বাস্থ্যের মানরক্ষার অধিকারসহ শ্রমিক শ্রেণীর বেশ কিছু অধিকারের কথা ঘোষণা করা হয়েছে।

* আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর প্রথম ১৯১৯ সালে কর্মক্ষেত্রে নারীদের জন্য কিছু আন্তর্জাতিক নীতিমালা গৃহীত হয়। নীতিমালায় নারীকে রাত্রিকালীন কাজ কষ্টসাধ্য শারীরিক কাজ, মাইন খনিতে কাজ ইত্যাদি থেকে রক্ষা করে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা রাত্রিকালে দীর্ঘ সময় কাজ করে নারীদের বেশি উপার্জন বিপজ্জনক কাজ, যার ক্ষতিপূরণ বেশি অঙ্কের, সে সব কাজ নারীদের জন্য নিষিদ্ধ করে দেয়।

* আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা কর্তৃক গৃহীত কনভেনশনগুলোর বেশ কিছু বাংলাদেশ সরকার অনুমোদন করেছে। বাংলাদেশ শ্রমআইনের আওতায় সব কনভেনশনের আলোকে বিভিন্ন আইন, বিধিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের নারীদের জন্য কর্মক্ষেত্রে নিরাপদ রক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। কর্মক্ষেত্রে নারী যেন বৈষম্যের শিকার না হয় তার বিধি-বিধানও করা হয়েছে। আইএলওর সদস্যরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ আইএলও সনদ, আন্তর্জাতিক শ্রমমান এবং ঘোষণাগুলোর প্রতি সম্মান দেখাতে অঙ্গীকারবদ্ধ।

* ১৯৯৫-এর সেপ্টেম্বরে বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ আয়োজিত চতুর্থ বিশ্বনারী সম্মেলনের গৃহীত প্লাটফরম ফর অ্যাকশনের ১৬৭ ধারায় কর্মে নিয়োগের সুযোগ, উপযুক্ত কাজের পরিবেশ এবং ভূমি, মূলধন প্রযুক্তির ওপর নিয়ন্ত্রণসহ নারীর অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। প্লাটফরম ফর অ্যাকশনের ১৮০ ধারায় কর্মক্ষেত্রে পেশাগত পৃথকীকরণ বৈষম্য দূর করার জন্য সরকারের নিয়োগকারী, ট্রেড ইউনিয়ন নারী সংগঠনগুলোর করণীয় বিষয়ে বলা হয়েছে। ১৮১ ধারায় সুপরিবর্তনীয় কাজের পরিবেশে কাজের সুষ্ঠু সমন্বয় এবং পারিবারিক দায়-দায়িত্ব নারী পুরুষের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

* চা-শ্রমিকের অধিকার স্বার্থ রক্ষার জন্য বাংলাদেশে আইএলও সার্ক সামাজিক সনদ রয়েছে। সার্ক সামাজিক সনদ দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোকে তাদের নাগরিকদের জন্য 'মৌলিক চাহিদা পূরণ এবং প্রত্যেক নাগরিকের ব্যক্তিমর্যাদা, নিরাপত্তা এবং সৃষ্টিশীলতা নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করতে বলেছে।' সনদে মৌলিক শিক্ষার সুযোগ, বাসস্থানের নিশ্চয়তা, নিরাপদ পানি পয়ঃনিষ্কাশনের সুবিধা এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যসুরক্ষা_এসব বিষয়ের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে যেগুলো আইন, নিবার্হী প্রশাসনিক নিয়ম দ্বারা নিশ্চিত করা উচিত। এতে 'পর্যাপ্ত আশ্রয়, খাদ্য পোশাকসহ মানসম্পন্ন জীবনমান' নিশ্চিত করার কথাও বলা হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক সনদগুলো অনুসমর্থন করলেও, যতক্ষণ না এগুলো দেশের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হয় ততক্ষণ পর্যন্ত এগুলোর কার্যকারিতা নেই। সে কারণে প্রচলিত আইনগুলো বাস্তবায়িত করা জরুরি।

নারী শ্রমিকদের বৈষম্য প্রতিরোধে কিছু প্রস্তাব

* দেশের সংবিধান স্বীকৃত আন্তর্জাতিক সনদগুলো অনুসরণপূর্বক কর্মক্ষেত্রে নারীর সমান অংশীদারিত্ব, সমান সুযোগ, সমমর্যাদা এবং সম-আচরণ নিশ্চিত করতে হবে।

* নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন, দারিদ্র্য দূরীকরণ, শ্রমবাজারে নারীর অধিক অংশগ্রহণ এবং জাতীয় অর্থনীতিতে নারীর অবদানের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে নারীর প্রতি যেকোনো ধরনের বৈষম্যের অবসান ঘটাতে হবে।

* নারীর জন্য নিরাপদ, স্বাস্থ্যসম্মত এবং নারীবান্ধব কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি মাতৃত্বকালীন সুরক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে
* শ্রমিক কল্যাণ ফাউণ্ডেশনকে সক্রিয় করা এবং ওই ফাউণ্ডেশনের মাধ্যমে শ্রমিকের জীবনমান বিশেষ করে শ্রমিকের আবাসন, স্বাস্থ্যসেবা তাদের সন্তানদের শিক্ষা নিশ্চিত করার ব্যাপারে উন্নয়নের উদ্যোগ গ্রহণ

* শ্রমঘন এলাকায় শ্রমিকের জন্য সরকারি হাসপাতাল দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন করা।

* প্রতিটি শিল্প-কারখানায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাসহ মাতৃত্বকালীন চিকিৎসাসেবা শিশু পরিচর্যার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।
* নারী শ্রমিকের মাতৃত্বকালকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় বিবেচনা করা সে লক্ষ্যে সব প্রতিষ্ঠানে স্থায়ী-অস্থায়ী সব ধরনের নারী শ্রমিকের জন্য বেতনসহ প্রসূতিকালীন ছুটি ছুটি শেষে চাকরির নিশ্চয়তা প্রদান করা।

* সব প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক-কর্মচারীদের জন্য প্রভিডেন্ট ফাণ্ড, গ্রাচুইটি অবসরকালীন ভাতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আইনের বাস্তবায়ন করতে হবে।

* দুর্ঘটনায় আহত বা পেশাগত অসুস্থতায় কর্মহীন শ্রমিকদের জন্য আইন পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ নিশ্চিতকরণ
* নিরাপদ কর্মক্ষেত্র শ্রমিকের পেশাগত স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। বিষয়ে একটি পৃথক নীতিমালা তৈরি

করতে হবে এবং ওই নীতিমালার আলোকে শ্রমআইনের সংশোধন, বাস্তবায়ন, পরিবর্ধন ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে।


* সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে শ্রমিকদের জন্য আবাসিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
* রাত টার পর নারী শ্রমিকদের দিয়ে কারখানার কাজ না করানো।
* আর্থিক নিরাপত্তার জন্য নূ্যনতম মজরি প্রতিটি কারখানায় বাস্তবায়ন করা।
* মাস শেষে সময়মতো মজরি ওভারটাইমের টাকা পরিশোধ করা।
* শ্রমিকদের নিয়োগপত্র প্রদান করা এবং চাকরিচ্যুতির সময় দেশের প্রচলিত শ্রমআইনের বিধানগুলো অনুসরণ করা।
* সুষ্ঠু সংগঠিত ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা করা।
* নারী পুরুষভিত্তিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে আইন প্রণয়ন কার্যকর করা।
* মহিলা শ্রমিকের দক্ষতা বাড়ানো।
* নারী পুরুষের জন্য সমান সুযোগের নীতি উন্নয়নে নিয়োগকর্তার আচরণ, ভূমিকা, জবাবদিহিতা অন্যান্য বিষয়ের জন্য সরকারের ভূমিকা শক্তিশালী করা।

নারী শ্রমিকের সব রকম বৈষম থেকে রক্ষা করার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ, সুনির্দিষ্ট রক্ষামূলক কাজের শর্তাবলি আইনে থাকলেই হবে না, তা বাস্তবায়িত করতে হবে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা কর্তৃক গৃহীত বিভিন্ন কনভেনশনের আলোকে নারী শ্রমিকের স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে যে আইনগুলো প্রণীত হয়েছে সেগুলোকে বাস্তবে প্রতিফলিত করতে হবে এবং সে সঙ্গে বর্তমান সময়ের আলোকে নারী শ্রমিকের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য যুগোপযোগী ব্যবস্থাগুলো গ্রহণ করতে হবে। সেজন্য একদিকে সরকারকে যেমন উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে তেমনি নিয়োগকারীদেরও এগিয়ে আসতে হবে নারী শ্রমিকের অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা প্রবৃদ্ধির জন্য।






শ্রম আইনে শিশু কিশোরের অবস্থান


প্রাচীন রোমে সমাজের বিভিন্ন পেশাজীবীদের পারিশ্রমিক বা মজুরি নির্ধারণের জন্য শ্রম আইনের উৎপত্তি বলে অনেকের ধারণা। ১৮০২ সালে ইংল্যান্ডে শ্রম শিল্প আইনের গোড়াপত্তন হয়। ১৯১৯ সালে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) মাধ্যমেই শ্রম আইন বাস্তবে রূপ নেয়। ব্রিটিশ আমলের ১৫টি, পাকিস্তান আমলের ২৩টি এবং বাংলাদেশ আমলের ১২টি, মোট ৫০টি শ্রম শিল্প আইন প্রচলিত ছিল বাংলাদেশে। ইতস্তত বিক্ষিপ্ত শ্রম শিল্প আইনগুলোকে একত্রিত করে এবং কিছু বাতিল করে জারি করা হয় বাংলাদেশ শ্রম আইন-২০০৬। প্রয়োজনে এখন আর কাউকে দৌড়াতে হয় না শ্রম আইন থেকে শ্রম আইনে। হাতের কাছে পাওয়া যায় শ্রম আইন।

বাংলাদেশ শ্রম আইন-২০০৬ অনুযায়ী ১৪ বছর পূর্ণ হয়নি এমন ব্যক্তিকে শিশু বলা হয়। কিশোর বলতে যে ব্যক্তি ১৪ বছর পূর্ণ করেছে; কিন্তু ১৮ বছর পূর্ণ করেনি তাকে বোঝায়। ১৮ বছর পূর্ণ করেছেন এমন ব্যক্তিকে প্রাপ্তবয়ষ্ক বোঝায়। শ্রমিক বলতে বোঝায় 'শিক্ষাধীনসহ কোনো ব্যক্তি, তাহার চাকরির শর্তাবলি প্রকাশ্য বা উহ্য যেভাবে থাকুক না কেন, যেন কোনো প্রতিষ্ঠানে বা শিল্পে সরাসরিভাবে বা কোনো ঠিকাদারের মাধ্যমে মজুরি বা অর্থের বিনিময়ে কোনো দক্ষ, অদক্ষ, কায়িক, কারিগরি, ব্যবসা, উন্নয়নমূলক অথবা কেরানিগিরির কাজ করার জন্য নিযুক্ত হন, কিন্তু প্রধানত প্রশাসনিক বা ব্যবস্থাপনামূলক কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তি ইহার অন্তর্ভুক্ত হইবেন না।'

বাংলাদেশ শ্রম আইন-২০০৬ অনুযায়ী কিশোরকে কাজে নিয়োগ করতে হলে মালিকের কাছে রেজিস্টার্ড চিকিৎসক কর্তৃক কিশোরের কাজে সক্ষমতা প্রত্যয়নপত্র থাকতে হবে। কিশোরকে কাজে থাকাকালীন প্রত্যয়নপত্রে উল্লেখ-সংবলিত একটি টোকেন বহন করতে হবে। যাতে বোঝা যাবে সে কাজে সক্ষম। কোনো কিশোর শিক্ষাধীন হিসেবে অথবা বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের জন্য নিয়োগের ক্ষেত্রে রেজিস্টার্ড চিকিৎসক কর্তৃক সক্ষমতা প্রত্যয়নপত্র টোকেন বহনের প্রয়োজন হবে না। দেশে জরুরি অবস্থা বিরাজমানকালে অথবা জনস্বার্থে সরকার প্রজ্ঞাপন দ্বারা সক্ষমতা প্রত্যয়নপত্র টোকেন বহন স্থগিত করতে পারে। আইনের বিধান সাপেক্ষে কোনো শিশুর মা-বাবা বা অভিভাবক শিশুকে কাজের অনুমতি প্রদান করে কারো সঙ্গে কোনো চুক্তি করতে পারবেন না।

যদি কোনো ব্যক্তি শিশু নাকি কিশোর সম্পর্কে প্রশ্ন দেখা দিলে পরিদর্শক বিষয়টি রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের কাছে সিদ্ধান্তের জন্য প্রেরণ করবেন। বিষয়টিতে রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের প্রত্যয়নপত্র চূড়ান্ত।

কোন কিশোর কোন পেশা বা প্রতিষ্ঠানে কাজের উপযোগী তা প্রমাণের জন্য রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের সক্ষমতা-প্রত্যয়নপত্রের প্রয়োজন। মালিকের খরচে কিশোরের মা-বাবা বা অভিভাবক সক্ষমতা প্রত্যয়নপত্র সংগ্রহ করবেন। কোনো পরিদর্শক যদি মনে করেন, কোনো প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তি কিশোর কিন্তু তার সক্ষমতা প্রত্যয়নপত্র নেই অথবা প্রত্যয়নপত্রে উলি্লখিত কাজের জন্য কিশোরটি আর সক্ষম নয়; সে ক্ষেত্রে পরিদর্শক নোটিশ মারফত মালিককে কিশোরটিকে রেজিস্টার্ড চিকিৎসক দ্বারা পরীক্ষা করানোর জন্য অনুরোধ করতে পারেন। রেজিস্টার্ড চিকিৎসক কিশোরটিকে সক্ষম বলে প্রত্যায়িত না করা পর্যন্ত বা কিশোরটি আর কিশোর নয় মর্মে প্রত্যায়িত না হওয়া পর্যন্ত তাকে আর কাজ না দেওয়ার জন্য নির্দেশ দিতে পারেন।

কোনো প্রতিষ্ঠানে যন্ত্রপাতি চালু অবস্থায় তা পরিষ্কারের তেল প্রদানের জন্য বা চালু অবস্থায় যন্ত্রপাতির ঘূর্ণায়মান অংশগুলোর মাঝখানে কিশোরকে কাজ করতে অনুমতি দেওয়া যাবে না। কোনো কিশোরকে যন্ত্রপাতির বিপদ সম্পর্কে ধারণা না দিয়ে সেখানে কাজ করানো যাবে না। বিপজ্জনক যন্ত্রপাতিতে কোনো অভিজ্ঞ ব্যক্তির অধীনে অথবা প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকলে কাজ করতে পারবে। বিপজ্জনক যন্ত্রপাতির তালিকা সরকার গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে প্রকাশ করবে। সরকার বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজের তালিকা প্রকাশ করলে সেখানে কোনো কিশোর-কিশোরীকে নিয়োগ করা যাবে না।

কোনো কিশোরকে কোনো কারখানায় বা খনিতে দৈনিক পাঁচ ঘণ্টার অধিক এবং সপ্তাহে ৩০ ঘণ্টার অধিক কাজ করতে দেওয়া হবে না। কোনো প্রতিষ্ঠানে দৈনিক সাত ঘণ্টার অধিক এবং সপ্তাহে ৪২ ঘণ্টার অধিক কাজ করতে দেওয়া হবে না। সন্ধ্যা ৭টা থেকে সকাল ৭টার মধ্যবর্তী সময়ে কাজ করতে দেওয়া হবে না। যদি কোনো কিশোর অধিককাল কাজ করে, তাহলে কারখানায় বা খনিতে সপ্তাহে ৩৬ ঘণ্টা এবং প্রতিষ্ঠানে সপ্তাহে ৪৮ ঘণ্টার অধিক হবে না। প্রতিষ্ঠানে কিশোরের কাজের সময় দুটি পালার বেশি হবে না এবং কোনো পালার সময়সীমা সাড়ে সাত ঘণ্টার বেশি হবে না। একটি কিশোরকে কেবলমাত্র একটি রেলিতে নিয়োগ করা যাবে এবং পরিদর্শকের অনুমতি ব্যতীত ৩০ দিনের মধ্যে মাত্র একবার রেলি পরিবর্তন করা যাবে। কিশোর শ্রমিক সাপ্তাহিক ছুটি অন্যান্য শ্রমিকের ন্যায় সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবে। একই দিনে কোনো কিশোর একাধিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে পারবে না।

কোনো কিশোরকে ভূগর্ভে বা পানির নিচে কাজ করতে দেওয়া যাবে না। কোনো প্রতিষ্ঠানে কিশোর শ্রমিক নিযুক্ত থাকলে নির্ধারিত পদ্ধতিতে কিশোরের কর্মঘণ্টা সম্পর্কে কাজের নির্দিষ্ট সময় উল্লেখসহ একটি নোটিশ প্রদর্শন করতে হবে। সরকার নোটিশের ফরম রক্ষণাবেক্ষণের পদ্ধতি নির্ধারণ করতে পারবে।

বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬-এর তৃতীয় অধ্যায়ে যা কিছু থাকুক না কেন, ১২ বছর বয়ঃপ্রাপ্ত কোনো শিশুকে এমন হালকা কাজে নিয়োগ করা যেতে পারে, যা তার স্বাস্থ্য উন্নতির জন্য বিপজ্জনক নয় অথবা তার শিক্ষা গ্রহণকে বিঘি্নত করবে না। যদি শিশুটি বিদ্যালয়গামী হয়, তাহলে কাজের সময় এমনভাবে নির্ধারণ করতে হবে, যেন শিশুটির বিদ্যালয় গমন বিঘি্নত না হয়। কিশোর শ্রমিকের ক্ষেত্রে আইনের যে বিধানগুলো প্রযোজ্য, তার সব বিধান যতদূর সম্ভব শিশু শ্রমিকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

আমাদের দেশে অনেকের দাবি_বাংলাদেশে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ করতে হবে। বিষয়টি নিয়ে পত্র-পত্রিকায় পৃষ্ঠা ভরিয়ে ফেলেন কলমসৈনিকরা। আমি তাঁদের সঙ্গে একমত হতে পারলে খুশি হতাম। কিন্তু পারছি না বলে দুঃখিত। যে শিশুর মাঠেঘাটে খেলার বয়স, স্কুলে বই-খাতা নিয়ে যাওয়ার সময়; তাকে কাজ করতে হয় অতি ঝুঁকির কাজ। ছোটখাটো বাসের হেলপারি, লাফিয়ে উঠে বাসে পত্রিকা বিক্রি, রেলস্টেশন আর লঞ্চঘাটে ভারী বোঝা বহন আর লোহা ঝালাইয়ের কাজ করতে দেখে খুব কষ্ট হয়। কিন্তু করার কিছু নেই। একমাত্র জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র শিশু কিশোরকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে বিরত রাখতে পারে। আমাদের পোড়া কপালে জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র নেই। দুর্নীতিতে আমরা একটানা বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। আমাদের মুক্তিদাতা নেই; রয়েছে সর্বনাশদাতা।



ঐতিহাসিক রায় যৌনবৈষম্যের বিরুদ্ধে নেপালের

  সুপ্রিম কোর্টের রায়



গত বছরের ২১ ডিসেম্বর নেপালের সুপ্রিম কোর্ট একটি ঐতিহাসিক রায় দেন। ওই রায়ে সমকামিতার বাইরের সব ক্ষুদ্র যৌনসত্তার ব্যক্তিমানুষের অধিকার রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি সংরক্ষণের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

নেপালের চারটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার জনস্বার্থে দায়ের করা এই মামলায় সুপ্রিম কোর্ট প্রান্তিক যৌনসত্তার ব্যক্তিদের 'স্বাভাবিক' হিসেবে প্রতিপন্ন করার ওপর বিশেষ জোর দিয়েছেন। বিচারপতি বালামকৃষ্ণ এবং পায়ান কুমার ওঝার নেতৃত্বে গঠিত ডিভিশন বেঞ্চ রায়ে বলেন, "যদিও লিঙ্গ পরিচয়ের ভিত্তিতে সমকামী, উভকামী, রূপান্তরকামী এবং মধ্যবর্তীকামী (এলজিবিটিআই) ব্যক্তিরা 'পুরুষালি' অথবা 'মেয়েলি' বিভাজনে পড়ে না কিন্তু তারা 'স্বাভাবিক ব্যক্তি' এবং তাদের জাতীয় আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন দলিলে লিপিবদ্ধ সব অধিকার ভোগ করার সুযোগ দেওয়া উচিত।" রায়ে মানবাধিকার চুক্তি স্বাক্ষরদানকারী দেশ হিসেবে নেপালের রাষ্ট্রীয় বাধ্যবাধকতা স্মরণ ওই সব অধিকার ভোগ করার যোগ্যতা রাখেন। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১২() যেখানে স্বাধীনতার অধিকার বর্ণিত হয়েছে, তাকে জীবনের অধিকারের সঙ্গে সম্পৃক্ততার উদাহরণ হিসেবে নিয়ে আদালত দেখান ওই অনুচ্ছেদে নারী অথবা পুরুষ কথাটির উল্লেখ নেই। অর্থাৎ এই অধিকার প্রত্যেক স্বাভাবিক ব্যক্তির জন্যই প্রযোজ্য।

যেহেতু এলজিবিটিআইরা স্বাভাবিক ব্যক্তি হিসেবে গণ্য হবে, তাদের সম্মান মর্যাদার সঙ্গে সব স্বাধীনতা ভোগ করে নেপালি সমাজে বসবাসের অধিকার দেওয়া উচিত। আইনের বিধান ব্যতীত এই অধিকার ভোগের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা আরোপ করা যাবে না। সংবিধান অনুযায়ী কেবল নেপালের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব, বিভিন্ন বর্ণ, গোত্র, ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যকার হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক, অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা, জননৈতিকতা শালীনতার স্বার্থে অধিকার সীমাবদ্ধ করা যাবে। ক্ষেত্রে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১২()- বর্ণিত 'মর্যাদা সহকারে' স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়। সময়ের বিচারে রায়টি ঐতিহাসিক, কেননা এখনো বিশ্বের কোনো সর্বোচ্চ আদালত লিঙ্গ যৌন পরিচয় নির্বিশেষে যেকোনো ধরনের বৈষম্য লোপের পক্ষে নির্দেশনা দেয়নি।

আদালত বলেন, "নেপালের অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধানের ১২ থেকে ৩২ অনুচ্ছেদে প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক অধিকারের কথা বলা হয়েছে। সুতরাং তারা সংখ্যায় ক্ষুদ্র হলেও নেপালের নাগরিক হওয়ার সুবাদে অনুচ্ছেদ ১২()- উলি্লখিত 'আইনের বিধান ব্যতীত' শব্দগুলো বেশ গুরুত্বপূর্ণ।" আদালত বলেন, 'এই দুটি অনুচ্ছেদে বর্ণিত শব্দগুলোর ব্যাখ্যা এমনভাবে করা যাবে না, যা এলজিবিটিআই ব্যক্তিদের মানবাধিকার মৌলিক অধিকার ভোগকে বাধাগ্রস্ত, সীমাবদ্ধ বা ক্ষতিগ্রস্ত করে।'

রায়ে আরো বলা হয়, যারা লিঙ্গ পুনর্নির্ধারণ সার্জারির মধ্য দিয়ে নিজেদের লিঙ্গ পরিবর্তন করেছে তারা ব্যতীত সব এলজিবিটিআই ব্যক্তি প্রাকৃতিকভাবেই বেড়ে ওঠে। প্রাকৃতিকভাবে লিঙ্গ নিয়ে জন্মগ্রহণকারী ব্যক্তিদের অনেকে সুসামঞ্জস্যপূর্ণ উচ্চতা ওজন এবং সুস্থ, শারীরিক মানসিক স্বাস্থ্যের অধিকারী। আবার অনেকেই প্রতিবন্ধী, মানসিকভাবে পর্যুদস্ত, জন্মগতভাবে অন্ধ, মূক বধির। এই দুই ধরনের ব্যক্তির মধ্যে শুধু পার্থক্য হলো, এরা প্রত্যেকেই নির্ধারিত নারী বা পুরুষ লিঙ্গ নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছে। যেহেতু তাদের লিঙ্গ নির্ধারিত, তাই তাদের মৌলিক অধিকার ভোগের ক্ষেত্রে তেমনটা বাধা লক্ষ করা যায় না। নারী পুরুষের প্রতি আকৃষ্ট বোধ করার চেষ্টা যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রে সমলিঙ্গের প্রতি আকৃষ্টতা বোধ করা ছাড়া।

কিন্তু এলজিবিটিআই ব্যক্তিদের সঙ্গে এদের তেমন কোনো পার্থক্য নেই। ক্ষেত্রে আইন যদি শুধু মানুষ পরিচয়ের ভিত্তিতে প্রতিবন্ধী, বোবা, মূক বধিরদের মানবাধিকার মৌলিক অধিকার ভোগের নিশ্চয়তা দেয়, তাহলে শুধু ভিন্ন যৌন পরিচয়ের কারণে এলজিবিটিআই ব্যক্তিরা যখন এসব অধিকার ভোগ থেকে বঞ্চিত হয়, তবে তা অবশ্যই বৈষম্যমূলক। এলজিবিটিআই হওয়ার কারণে নাগরিক হিসেবে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি প্রতিষ্ঠানে অংশগ্রহণের সুযোগ, স্ব-স্ব পরিচয় উল্লেখপূর্বক নাগরিকত্ব কার্ডসহ অন্যান্য পরিচয়পত্র প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আবার বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মকর্তা হিসেবে আসীন এলজিবিটিআই ব্যক্তিরাও বিভিন্ন ধরনের অবমাননাকর আচরণের শিকার হচ্ছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, নেপাল নাগরিক রাজনৈতিক অধিকার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তি (আইসিসিপিআর) এবং অর্থনৈতিক, সামাজিক সাংস্কৃতিক অধিকার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তিতে (আইসিইএসসিআর) স্বাক্ষরদানকারী রাষ্ট্র। আইসিসিপিআরের অনুচ্ছেদ-২৩ আইসিইএসসিআরের অনুচ্ছেদ-১০ অনুযায়ী কেবল নারী-পুরুষের বৈবাহিক সম্পর্কের অধিকার স্বীকৃত। নেপালের বর্তমান সম্পত্তি সংক্রান্ত আইনের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব এবং একমাত্র দুইজন বিপরীত লিঙ্গের বৈবাহিক সম্পর্ককে প্রশ্ন করে আদালত এই আইনের সীমাবদ্ধতা তুলে ধরেছেন। আইসিসিপিআরের অনুচ্ছেদ , ১৬ ১৭-কে ব্যাখ্যা সাপেক্ষে বলা যায়, রাষ্ট্রের কর্তব্য হলো নিজ নিজ পরিচয়ের ভিত্তিতে প্রত্যেক নাগরিককে স্বীকৃতি দেওয়া।

আইসিইএসসিআর এবং আইসিসিপিআর উভয় দলিলেই আত্মমর্যাদা আত্মসম্মানে হানি ব্যতিরেকে পারিবারিক জীবনে গোপনীয়তার কথা বলা হয়েছে। নেপাল চুক্তি আইন ১৯৯০-এর ধারা অনুযায়ী এসব বিধান নেপালি আইনি বিধানের সমতুল্য। কাজেই এলজিবিটিআই ব্যক্তিরা কোনোরূপ বৈষম্য ছাড়া নিজ নিজ পরিচয় সহকারেই পারিবারিক জীবনে গোপনীয়তার অধিকার ভোগের অধিকারী। রায়ে আইসিইএসসিআর এবং আইসিসিপিআরের মতো আন্তর্জাতিক সনদে নেপালের পক্ষভুক্তি হিসেবে সংবিধান আন্তর্জাতিক সনদগুলোর সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদের একটি সুষম সমন্বয় ঘটানোর পক্ষে মত প্রকাশ করা হয়েছে।

রায়ে উল্লেখ করা হয়, সংবিধানের চতুর্থ অধ্যায়ের যেসব রাষ্ট্রীয় নির্দেশাত্মক নীতির বর্ণনা রয়েছে, সেগুলোর ভিত্তিতে আবেদনকারীরা নিজ পরিচয়ের ভিত্তিতে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ভোগ করার অধিকার রাখে। বিষয়গুলোর প্রতি দৃষ্টি রেখেই রায়ে নেপাল সরকার বরাবর উপযুক্ত আইন প্রণয়ন এবং সেই সঙ্গে বৈষম্যমূলক আইন সংশোধন উপযুক্ত পরিবেশ তৈরির নজরদারির নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। সমকামীদের বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের স্বীকৃতির বিষয়টি সুরাহা করতে আদালত একটি কমিটি গঠন করার নির্দেশনা দেন। এই কমিটি বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন দেশের অবস্থান পর্যবেক্ষণ গবেষণা করবে। সাত সদস্যবিশিষ্ট প্যানেলের সম্ভাব্য সদস্যদের তালিকায় চিকিৎসক, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রতিনিধি, আইনজীবী, পুলিশ, সমাজবিজ্ঞানী, সরকারের জনসংখ্যা পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের ব্যক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করেন আদালত।

সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পেশাজীবীর সমন্বয়ে গঠিত এই ব্যাপকভিত্তিক তালিকাটিতে আদালতের বিষয়টির প্রতি আন্তরিকতা বিচক্ষণতা প্রকাশ পেয়েছে। মানবাধিকার আইনজীবী হরি ফুয়াল, যিনি এই মামলার একজন এমিকাস কিউরি হিসেবে কাজ করছেন, তিনি এক প্রতিক্রিয়ায় এই সংখ্যালঘু মানুষদের নাগরিকত্ব, পাসপোর্ট এবং অন্যান্য আইনি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারের দায়িত্বের বিষয়টি আদালত পুনর্ব্যক্ত করায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন

No comments:

Post a Comment